Wellcome to National Portal
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ২৩rd সেপ্টেম্বর ২০১৪

মোটাতাজাকরণে নতুন ব্রাহমা ক্রস উদ্ভাবন দেশের মাংস চাহিদায় সৃষ্টি করবে নয়া দিগন্ত


প্রকাশন তারিখ : 2014-04-17

 মোটাতাজাকরণে অধিক উপযোগী নতুন ব্রাহমা ক্রস উদ্ভাবন দেশের মাংস চাহিদায় সৃষ্টি করবে নয়া দিগন্ত

স্বাধীনতার পর দেশে মেধাবী জাতি গঠনে দুধ উৎপাদনের লক্ষ্যে আমাদের দেশে বিদেশ থেকে অধিক দুধ উৎপাদনকারী গাভীর জাত এনে দেশীয় জাতের সাথে সংকরায়নের মাধ্যমে উন্নত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে বর্তমানে দুগ্ধ খাতে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জিত হলেও মোট চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ করতে সম্ভব হচ্ছে। উন্নত জাতের সাথে সংকরায়নের ফলে দেশীয় গাভীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা দিনে     ১-১.৫ কেজি হতে ৫-৭ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে মাংস উৎপাদনকারী কোনো জাত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে মাংস উৎপাদনকারী গরুর যে পৃথক জাত আছে সে সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দুধ উৎপাদনকারী গরুর ষাঁড় বাছুরকেই মাংস উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করে আসছেন গরু মোটাতাজাকরণ খামারীরা। দুধ উৎপাদনকারী গরুর মধ্যে মাংস উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য (জিন) না থাকায় সঠিক লালন-পালন ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করেও কাঙ্খিত সাফল্য পায় না খামারীরা। ফলে গরুর অধিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক হরমোন ব্যবহার করা হয়। এসকল রাসায়নিক হরমোন গরুর শরীরের কোষে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মোটাতাজা করে। এসব হরমোন ব্যবহারের ফলে গরুকে দেখতে মোটাতাজা মনে হলেও তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কারণ ব্যবহারকৃত ওই সকল রাসায়নিক হরমোনের ক্ষতিকর প্রভাব গরুর মাংসের মধ্যে থেকে যায় যা পরবর্তীতে মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে চলে আসে এবং তা মানুষের ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, শিশুদের শরীরের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে। 
তবে কোনো প্রকার রাসায়নিক হরমোন ব্যবহার না করেই অধিক মাংস উৎপাদনকারী গরুর ক্রস উদ্ভাবনে সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশু প্রজনন বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল হক। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অর্থায়নে পশুপালন অনুষদের পশুবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুজাফফর হোসেনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত উচ্চ শিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিন বছর মেয়াদী ‘‘দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রির উদ্ভাবনমুখী গবেষণা’’ প্রকল্পের ব্রাহমাঃ গরু মোটাতাজাকরণের সম্ভাবনাময় জাত শীর্ষক উপ-প্রকল্পের অধীনে অধ্যাপক ড. আজহারুল হক ওই সাফল্য পান। এ গবেষণায় ড. আজহারকে সাহায্য করেন তার পিএইচডি ছাত্র নন্দী গোপাল সাহা।
অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল হক সম্ভবনাময় ব্রাহমা জাতটি সম্পর্কে বলেন, দেশে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন গবেষণা ও নীতিমালা নির্ধারণ করা হলেও মাংস উৎপাদনকারী গরুর জাত উন্নতকরণে কার্যত কোনো গবেষণা বা নীতিমালা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে দেশে মাংস উৎপাদনকারী কোনো গরুর জাত তো নেইই অপরদিকে কোনো অধিক মাংস উৎপাদনকারী উন্নত গরুর সংকর জাতও আমাদের দেশে ছিল না। ফলে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণে আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সীমান্ত দিয়ে অবাধে আমাদের দেশে ভারতীয় গরু প্রবেশ করায় নতুন নতুন রোগে সংক্রামিত হচ্ছে দেশীয় প্রাণিসম্পদ। অপরদিকে মাংস উৎপাদনের জন্য কাঙ্খিত কোনো গরুর জাত না থাকায় গরু মোটাতাজাকরণ খামারীরা দুধ উৎপাদনকারী গরুর ষাঁড় বাচ্চাকে মাংস উৎপাদনের জন্য লালন-পালন করেন। অল্প সময়ে অধিক মাংস উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য ওই সকল ষাঁড় বাছুরে না থাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাবার ও ব্যবস্থাপনা সরবরাহ করেও কাঙ্খিত ফল পান না খামারীরা। ফলে খামারী গরুকে বাজারজাত করার ২-৩ মাস আগে অধিক মাংসবর্ধক রাসায়নিক হরমোন স্টেরয়ড ব্যবহার করেন। স্টেরয়ড ইনজেকশন ব্যবহারের ফলে গরুর আকার ও ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রাসায়নিক হরমোন মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি গরুর জন্যও ক্ষতিকর। স্টেরয়ড ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় পর গরুকে জবাই না করলে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে গরু মারা যেতে পারে। 
কিন্তু দেশীয় গাভীকে অধিক মাংস উৎপাদনকারী ব্রাহমা জাতের সাথে প্রজনন করানোর পর যে ষাঁড় বাছুর পাওয়া যাবে তা দেশীয় ও দুধ উৎপাদনকারী গরুর জাতের থেকে দ্রুত বর্ধনশীল ও অধিক মাংস উৎপাদনক্ষম। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বাংলাদেশে প্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাংস উৎপাদনে বিশ্বে এক নম্বর জাত ব্রাহমার বীজ সংগ্রহ করে দেশের ১২টি স্থানে দেশীয় গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন করানোর পর ব্রাহমা ক্রসের প্রথম প্রজন্ম সৃষ্টি করে। এ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন স্থানের  ব্রাহমা ক্রসের ৪টি ভালো মানের ষাঁড়কে সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে আনা হয়। সংগৃহীত সংকর ষাঁড় থেকে পরবর্তীতে বীজ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত বীজ কৃত্রিম প্রজনন কর্মীর মাধ্যমে ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বয়রা, ভবখালি ও গৌরীপুর উপজেলার ডোয়াখোলা ইউনিয়নের ১৩৯২ টি গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন করানো হয়।  প্রজননকৃত গাভী থেকে প্রাপ্ত দ্বিতীয় প্রজন্মের ষাঁড় বাছুরের দৈনিক দৈহিক বৃদ্ধি ৭০০ গ্রামের বেশি পাওয়া গেছে যেখানে একটি দেশী জাতের গরুর দৈনিক দৈহিক বৃদ্ধি ১৫০-২০০ গ্রাম।
ড. আজহার সংকরায়ন নিয়ে আরো বলেন, ব্রাহমা জাতটি ভারতীয় উপমহাদেশের বংশোভূত হওয়ায় বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য অনুকূল; ফলে রোগ বালাই হয় না বললেই চলে। তাই এ জাতের গরু লালন পালন ব্যবস্থাপনা দেশীয় প্রজাতির গরুর মতই। তবে এ জাতের গরুর বাচ্চা জন্মের পর আকারে বড় হওয়ায় বাছুরের পরিচর্যা একটু বেশি নেওয়া প্রয়োজন হয়। তাই জন্মের ৩ মাস পর্যন্ত বাছুরকে প্রতিদিন ১.৫-২ কেজি দুধ বেশি খাওয়ানো প্রয়োজন। সুস্থ অবস্থায় অন্যান্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে ৬ মাস বয়স ছাড়াও প্রতি বছর কৃমিনাশক ওষুধ এক মাত্রা করে খাওয়াতে হবে। 
জাতটির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপক ড. মুজাফফর হোসেন বলেন, অধিক মাংস উৎপাদনে সক্ষম ষাঁড় বাছুরের অভাবে বাণিজ্যিকভিত্তিতে মুরগির মাংস উৎপাদনের মত দেশে বাণিজ্যিকভিত্তিতে গরুর মাংস উৎপাদনকারী তেমন কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ব্রাহমার সংকর জাত সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে স্বাস্থ্যসম্মত গরুর মাংসের বাণিজ্যিক শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। অন্যদিকে স্বল্প সময়ে এবং কম খরচে ব্রাহমা ক্রস অধিক মাংস উৎপাদন করায় দেশে গরুর মাংসের চাহিদা পূরণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্রাহমার সংকর জাতের দ্বিতীয় প্রজন্মকে নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বিশুদ্ধ ব্রাহমার সাথে সংকরায়ন করার মাধ্যমে দেশীয় আবহাওয়ার উপযুক্ত অধিক মাংস উৎপাদনকারী নতুন একটি গরুর জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন গবেষক ড. আজহারুর ইসলাম। সেক্ষেত্রে সরকার ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে মাংস উৎপাদনে আগ্রহী উদ্যোক্তরা প্রকল্পটি চালিয়ে যেতে আর্থিক সহযোগিতা করলে যেমন গরু লালন পালনকারী খামারীরা তাদের পশুর জন্য খাদ্য, পথ্যের পাশাপাশি তাদের গরুর নায্য মূল্য পাবে তেমনি সরকারি বেসরকারি কোম্পানীগুলো তাদের কোম্পানীর জন্য রাসায়নিক ক্ষতিকর হরমোনবিহীন প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গরুর মাংস গরু পালনকারী খামারীদের কাছ থেকে সহজেই ক্রস করতে পারবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র  এসব খামারীদের বীজ সরবরাহ করার মাধ্যমে ওই সব গরুকে প্রজনন করিয়ে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণ করে কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।